অতিরজ বা অতিরিক্ত রক্তস্রাবের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা
অতিরজ বা
অতিরিক্ত রক্তস্রাবঃ স্ত্রীলোকগণের মাসিক ঋতুর অত্যাদিক স্রাবকে অতিরজ বা মেনোরেজিয়া (Menorrhagia) বলে। পূর্বে জরায়ু হতে যে কোন স্রাবকে
অতিরজ বলা হত,
কিন্তু
বর্তমানে অতিরিক্ত স্রাবকেই অতিরজ বলা হয়। ঋতুর সাথে সম্পর্কহীন স্রাবকে
জরায়ু স্রাব বলে।
অতিরজকে
তিনটি সাধারণ বিভাগে ভাগ করা যায়, যথা-
ক) ক্রিয়াবিকার কার্যবিকৃত জনিত
অতিরজ (Functional
menorrhagia): এতে
স্রাব পরিমাণে বা দ্রুততায় অথবা উভয় প্রকারেই বর্ধিত হয়।
খ)
যান্ত্রিক অতিরজ (Organic menorrhagia): এতে যৌনযন্ত্রের কোন নিশ্চিত বিকলতার জন্য স্রাব হয়ে থাকে।
গ)
সহানুভূতিক অতিরজ (Sympathetic menorrhagia): এতে কোন সাধারণ ব্যাধির গুরুতর আকার ধারণের জন্য
অতিরিক্ত স্রাব হয়।
অতিরজ বা Menorrhagia
কারণ-
ক) জরায়ু বা যোনি পথে টিউমার।
খ) জরায়ু মুখ বা যোনি গাত্রে
পলিপাস।
গ) জরায়ু বা যোনি অভ্যন্তরে
ক্যান্সার।
ঘ)
ডিম্বকোষ বা ডিম্বনালীর প্রদাহ।
ঙ) জরায়ু স্থানচ্যুতি বা জরায়ুর অধঃগমন ( Prolapse )।
চ)
স্ত্রী হরমোনের গন্ডগোল।
ছ)
ঋতুস্রাবে বিলম্ব।
জ)
রোগীণীর রক্তস্রাবের প্রবণতা।
ঝ)
গর্ভপাত ( Abortion
) অথবা
প্রসবের ( Delivery
) পর জরায়ুর মধ্যে ফুলের অংশ
আটকে থাকলে।
অতিরজ
লক্ষণসমূহঃ
ক) ঋতুস্রাব অধিক
পরিমাণে হওয়ার কারণে রোগিণী রক্তল্পতায় ভুগতে থাকে। মাসিক
স্রাব ৭-১০ দিন বা তার বেশী স্থায়ী হতে পারে।
খ)
টিউমার বা পলিপাস থাকলে চাপা চাপা রক্তের ডেলা সঙ্গে তরল রক্ত জরায়ু থেকে নির্গত হয়।
গ)
হরমোনের অভাবজনিত কারণে ঋতুস্রাবে বিলম্ব হওয়ার পর মাসিক শুরু হলে
কোমর, তলপেট ও জরায়ুতে ব্যথাসহ প্রচুর
ঋতুস্রাব হয়।
ঘ)
রক্তস্রাবের রং ( Color of blood ) বিশেষ করে বয়স্কা নারীর ক্ষেত্রে কালচে মাছ ধোয়া জলের ( Blackish, fishy
water) মত
অল্প অল্প করে বহু দিন হয়।
অতিরজ বা
অতিরিক্ত রক্তস্রাব এবং হোমিওপ্যাথিঃ
একোনাইটঃ বিশেষভাবে রক্তপ্রধান
ধাতুবিশিষ্টা স্ত্রীলোকদের অতিরজে উপকারী। রোগিণী শোয়া থেকে উঠলে মাথা ঘুরতে
থাকে, আবারও শোতে বাধ্য হয়। রোগিণী উত্তেজিত এবং
ভীতা; ভয়ের কোন কারণ না থাকলেও
সে মারা যাবে এটাই নিশ্চিত করে বসে। রোগের অবস্থা আরোও খারাপ হবে, সবসময় এই ভয় করে।
এগারিকাসঃ ঋতু অত্যান্ত অধিক, জননযন্ত্রে তির্তির্ অনুভূতি।
ঋতুস্রাব পরিমাণে খুবই বেশি এবং জ্বালা এর প্রধান বিশেষত্ব।
এম্ব্রাগ্রিসিয়া দুই ঋতুর মধ্যবর্তী সময়ে রক্তস্রাব। অতি
সামান্য কারণেই রক্তস্রাব। বাহ্যের পর বা তুলনামূলকভাবে একটু বেশি চলাফেরা করলেই
রক্তস্রাব হয়।
এমন কার্বঃ অত্যান্ত বেদনার সাথে কালো চাপ
চাপ রক্তস্রাব। পেট ও কোমরে অত্যান্ত বেদনা। ঋতুকালে কলেরার ন্যায় লক্ষণ প্রকাশ পায়।
এমন মিউরঃ কোমরে এবং পেটে ভয়ানক ব্যথার সাথে যথা-সময়ের আগেই পরিমাণ
ঋতুস্রাব। স্রাব দিনে কম থাকে অথবা বন্ধ থাকে; কিন্তু রাত্রে বাড়ে। ঋতুকালে
প্রতিবার বাহ্যের সময়ে জরায়ু হতে কিছুটা রক্ত নির্গত হয়।
এন্টিম ক্রুডঃ প্রসব ব্যথার ন্যায় ব্যথা বা জরায়ু হতে কিছু বের হয়ে যাবে এমন অনুভূতিসহ
অতিরিক্ত রক্তস্রাব।
এপিস মেলঃ জরায়ুর মধ্যে টাটানি জ্বালা; তীব্র হুলবিদ্ধ মত
যন্ত্রণাসহ অতিরজ। জরায়ু হতে যখন-তখন রক্তস্রাব। জরায়ুর নানাবিধ টিউমার বা
কর্কটরোগহেতু রক্তস্রাবে উপযোগী। শোথ (Edema), বিশেষ করে চোখের নিচের পাতায়(Lower eye lid) শোথ। পিপাসাহীনতা এবং
রোগিণীর মুক্তবায়ু ও ঠান্ডা দ্রব্যে আকাঙ্খা।
এপোসাইনাম ক্যানঃ একদিন বা দুইদিন স্বাভাবিক
রক্তস্রাবের পরে অত্যান্ত অধিক পরিমাণ রক্তস্রাব হয়। তরল রক্তের সঙ্গে
ঝিল্লিখন্ড নির্গত হয়।
আর্জেন্টাম নাইটঃ কোমরে ও কুঁচকিতে কেটে ফেলার ন্যায় বেদনাসহ অতিরজ। অল্পবয়স্কা বিধবাদের অতিরজ।
বন্ধ্যাত্বসহ অতিরজ। স্নায়ুবিক উত্তেজনা। পদদ্বয়ে অত্যান্ত দুর্বলতা
বোধ এবং মস্তক যেন ক্রমে বড় হচ্ছে এমন মনে হয়। অনাবৃত অবস্থায় শীতশীতভাব অথচ গায়ে কিছু দিলেও রোগিণীর
দম বন্ধ হয়ে আসে। রোগিণী উন্মুক্ত বায়ু চায়। স্বামিসহবাসে
বেদনাবোধ। রতিক্রিয়ার পরে জরায়ু হতে রক্তস্রাব।
আর্নিকা মন্টঃ পতন বা জরায়ুতে আঘাত লাগার পরে
অতিরজ। স্রাব উজ্জ্বল লালবর্ণের চাপ মিশ্রিত। কোমরে বেদনা, ঐ বেদনা কুঁচকিতে নেমে ঊরু বেয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল
পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। রোগিণীর পদদ্বয় ঠান্ডা কিন্তু মাথা গরম।
আর্সেনিক এল্বঃ অত্যান্ত দুর্বলা, কৃশা, রক্তহীনা, অবসন্না, নারীদের জন্য উপযোগী।
জরায়ু হতে দুর্গন্ধময় তরল শ্বেতপ্রদর স্রাব। অত্যন্ত
অস্থিরতা ( Restlessness
), উদ্বেগ
(Anxiety)
এবং
মৃত্যুভয়, বাতে আক্রান্ত রোগিণী। জরায়ুর মধ্যে জ্বালা, উদ্বেগ, জ্বর এবং মুখমধ্যে
ক্ষত। রোগিণীর অত্যন্ত অবসন্নাবস্থা।
বেলাডোনাঃ উজ্জ্বল লালবর্ণের রক্তস্রাব ঝলকে ঝলকে বের হয়। উষ্ণ রক্ত নির্গত হওয়ার সময়ে উষ্ণস্পর্শ মনে হয়। জরায়ুর নিচের দিকে চাপবোধ, মনে হয় যেন পেটের সব
নাড়িভুঁড়ি যোনিপথ দিয়ে বের হয়ে যাবে। প্রাতকালে এই ব্যথা বাড়ে
কিন্তু দাঁড়াইলে অথবা সরলভাবে উপবেশন করলে কমে। ডিম্বকোষে টাটানি এবং স্পর্শকাতর, হাত দেওয়া যায় না। পা ঠান্ডাসহ মাথা
গরমবোধ, ক্যারটিড ধমনীর (Carotid vein ) উল্লম্ফন।
বোরাক্সঃ অতি শীঘ্র শীঘ্র প্রচুর পরিমাণ ঋতুস্রাব হয়। বমনেচ্ছা এবং বেদনা
যা পাকস্থলী হতে কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। অত্যন্ত স্নায়বিক প্রকৃতির
স্ত্রীলোকের অত্যধিক ঋতুস্রাব। রোগিণী সামান্য শব্দেই চমকে উঠে এবং নিম্নগতিতে ভয় পায়, যেমন সিঁড়ি দিয়ে নিম্নাবতরণ বা নিচের
তলায় যাওয়া ইত্যাদি ( Dread of downward
motion ) ।
ব্রায়োনিয়াঃ ঋতু যথাসময়ের অনেক আগে অত্যধিক
পরীমাণে হয়। ঋতুস্রাব গাঢ় লালবর্ণের। কোমরে ব্যথা, মাথা ধরা,মনে হয় মাথা ফেটে
যাবে। সামান্য সঞ্চালনেও সমস্ত উপসর্গের বৃদ্ধি। শয়নাবস্থা হতে উঠে বসলে
এবং আহারের পরে বমনেচ্ছা।
ক্যাল্কেরিয়া কার্বঃ গৌরবর্ণা, স্থুলা বা মোটা এবং
শিথিল মাংশবিশিষ্টা স্ত্রীলোকদের অতিরজে বিশেষ উপযোগিতার সাথে ব্যবহৃত হয়। যে সকল স্ত্রীলোকের
সামান্য পরিশ্রমে প্রচুর পরিমাণে ঘর্ম হয় এবং রাত্রিকালেও অম্লগন্ধবিশিষ্ট
শ্বেদ নির্গত হয় তাদের পক্ষে উপযোগী।
ক্যান্থারিসঃ ঋতু যথাসময়ের পূর্বে অত্যন্ত অধিক
প্রকাশ পায়। ঋতুশোনিতের রং কালো, মূত্রত্যাগ কর্তনবৎ বেদনা এবং
জ্বালাসহ মূত্রকৃচ্ছতা। ঘনঘন মূত্রত্যাগের ইচ্ছা। বন্ধ্যা স্ত্রীলোকের পক্ষে
অধিকতর উপযোগী।
কার্বোভেজঃ অত্যন্ত শীঘ্র শীঘ্র প্রচুর পরিমাণে ঋতু স্রাব। যোনিতে
কন্ডূয়ন এবং জ্বালাজনক ক্ষত। ঋতুর পূর্বে মানসিক অবসাদ। যোনি হতে
দুর্গন্ধ স্রাব নিঃসরণ। পেটফাঁপা, দুর্গন্ধ বায়ু এবং মলনিঃসরণ। ঋতুশোনিত অত্যন্ত
পচা দুর্গন্ধযুক্ত। দুর্গন্ধযুক্ত বিদাহী শ্বেতপ্রদর। যেস্থানে লাগে সে স্থান
হেঁজে যায়।