বহু ব্যাপক সর্দি জ্বর (Influenza)
ইতিহাস-প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই প্রায় দশ লক্ষ লোক প্রাণ হারিয়েছিল এক রহস্যময় জ্বরের
ফলে-তার নাম দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধ জ্বর বা ওয়ার ফিভার। বিখ্যাত গ্রীক বীর
আলেকজান্ডার যে পথে ভারত আক্রমণ করেন,
ঠিক সেই
একই পথ ধরে এই রোগ ইউরোপ থেকে ভারতে আসে এবং ভয়ঙ্কর মহামারী সৃষ্টি করে। তার অনেক
পরে এই রোগ ইফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্ল বলে জানা যায়। বর্তমানে ইনফ্লুয়েঞ্জা আর হত্যাকারী
ব্যাধি বলে চিহ্নিত নয়। তার কারণ এ থেকে যেসব Complication দেখা দেয়, সেগুলি ছিল মারাত্মক।
বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য সেসব Complications আর দেখা দিতে পারে না। এই রোগের কারণ যেসব ভাইরাস, তারা 1933 সালে ইতিমধ্যে
আবিষ্কৃত হয়। তার আগে কেউ জানতো না, এ রোগের কারণ কি? সাধারণ লোকে মনে মনে ভাবতো-এ রোগের কারণ হলো নক্ষত্রদের
প্রতিক্রিয়া। তাই ইতালীর ভাষা অনুযায়ী এর নাম হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ। একটি বিরাট
মহামারীর আকারে পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে দেখা দেয়। প্রথম এশিয়াতে যে ফ্ল হয় তার নাম
হলো এশিয়াটিক ফ্ল, তা প্রথম চীনদেশে
থেকে শুরু, হয়। পরের বার এই রোগ শুরু হয়
হংকং থেকে তার নাম হংকং ফ্ল। প্রায়ই এটি বহুব্যাপক আকারে হয়, মাঝে মাঝে অল্প ব্যাপক অঞ্চল জুড়েও হয়।
ভ্যাকসিন
বা টিকা দিয়ে এ রোগ সহজে প্রতিরোধ করা যায় না তার কারণ অজস্র ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা
ভাইরাস আছে এবং তারা তাদের আকৃতি দ্রুত পাল্টাতে পারে। কোনও একটি ভ্যাকসিন দিয়ে সব
জাতের ভাইরাসের আক্রমণকে এড়ানো সম্ভব হয় না।
কারণ
ইনফ্লুয়েজা
রোগ এক ধরণের Acute রোগ, যা সৃষ্টি হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা গ্রুপের Myxovirus গুলি থেকে। এদের নানা ভাগ বা প্রকার ভেদ আছে-তবে
প্রধানতঃ তিনভাগে এদের ভাগ করা হয়, তা হলো গ্রুপ A, B এবং C। A জাতীয় ভাইরাস বহুব্যাপক বা Epidemic সৃষ্টি করে। B জাতীয় ভাইরাস স্থানীয়
অংশে বেশি রোগ সৃষ্টি করে। C জাতীয় ভাইরাস
অল্পদিনের মধ্যে হঠাৎ রোগ সৃষ্টি করে। এই তিন জাতের আকৃতির মধ্যেও আবার নানা
পরিবর্তন দেখা যায়। পরে রোগ হলে, এই সঙ্গে Strepto, Staphylo, Pneumo প্রভৃতি কক্কাসের ক্রিয়া শুরু
হয়।
লক্ষণ (Clinical Signs & Symptoms)-
Incubation-এর সময় হলো এক থেকে তিন দিন। বীজাণু দেহে প্রবেশ করলেই
প্রথমে যে সব লক্ষণ দেখা দেয় তা হলো-
(1) শরীরের অস্বস্তিবোধ
(2) মাথাধরা,
(3) গা, হাত, পা, চোখ, কোমরে ব্যথা,
(4) অক্ষুধা,
(5) কখনো বা বমি বমি ভাব ও বমি হয়,
(6) তারপর জ্বর হয়। জ্বর সাধারণতঃ
102-103 ডিগ্রী পর্যন্ত হয়। শীত করে
জ্বর আসে
(7) মুখ রক্তাভ হয়,
চোখ
দিয়ে জল পড়তে থাকে,
(8) নাড়ির ও শ্বাসের গতি
দ্রুততর হয়,
(9) প্রায়ই (Leucopenia) হয়। (2000 থেকে 4000 প্রতি কিউবিক
মিলিটারের),
(10) সর্দি ও শুকনো কাশি প্রভৃতি
দেখা দিতে পারে,
(11) শ্বাসনালীর উপরের অংশে প্রদাহ
হতে পারে এবং তখন রোগটি সঠিক চেনা হয়। রোগ দ্রুত বাড়ীর অন্যান্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে
পড়তে পারে।
সাধারণতঃ
চিকিৎসা হোক বা না হোক, রোগ সাতদিন পরে আপনা
থেকেই সেরে যায় যদি অন্যান্য
Complication দেখা না দেয়। তাই রোগের চিকিৎসার থেকেও Complication
গুলির
চিকিৎসা ও তা থেকে রোগীকে রক্ষা করা প্রাথমিক কর্তব্য। সাধারণ সর্দিজ্বর যে ভাইরাস
থেকে হয়, তাদের মেয়াদ মাত্র তিন দিন।
কিন্তু প্রকৃত তা হলে রোগীকে সাতদিন রোগে ভুগতে হয়। তাই বলা হয় যে, চিকিৎসা না করলে সাতদিনে সারে আর চিকিৎসা করলে এক সপ্তাহে
সারে।
জটিল অবস্থাদি -
(Complication)- অনেক সময় কোনও জটিল
অবস্থা দেখা দেয় না-রোগ আপনা থেকেই সেরে যায়। কিন্তু এই সঙ্গে অন্যান্য Coccus-দের ইনফেকশন হলে রোগ সহজে সারে না। তখন
ট্রেকাইটিস্, ব্রঙ্কাইটিস, ল্যারিঞ্জাইটিস,
নিউমোনিয়া
প্রভৃতি দেখা দেয়। যদি রোগীর আগে থেকে হার্টের রোগ থাকে তাহলে Toxic cardiomyopathy দেখা দিতে পারে এবং তা হলে
রোগীর হঠাৎ মৃত্যু হওয়া আশ্চর্য না। রোগীর স্বাস্থ্য খুব দুর্বল করে ফেলে এবং
জীবনীশক্তি কমিয়ে দেয়।
প্রতিবেষ (Prevention)
প্রতিরোধ
কঠিন। তবে রোগ চলতে থাকার সময় অল্প মাত্রায় চায়না ৩ খাওয়ালে প্রতিরোধ ক্ষমতা
বৃদ্ধি পায়। যে সব লোক ফুসফুস ও হার্টের রোগে ভুগছে, তাদের এক মাত্রা ইনফ্লুয়েজিনাম ৩০ বা ২০০ দিলে রোগ অনেকটা প্রতিরোধ করা সম্ভব
হয় বটে তবে তা নিশ্চিত ফলপ্রদ বলা যায় না। এক মাত্রার বেশি এই ঔষধ ব্যবহার
নিষিদ্ধ। রোগীকে ঘরে রাখা উচিত।
চিকিৎসা (Treatment)
- আক্রমণের প্রথম অবস্থায় শ্রেষ্ঠ ঔষধ হলো, অ্যাকোনাইট ৩ বা ৬। জ্বর, অস্থিরতা, পিপাসা প্রভৃতি লক্ষণ দেখা যায়।
- প্রথম অবস্থায় ফেরাম ফস্ ৩০ বা ৬৪ অতি উপকারী ঔষধ। 'In a case of Nascent cold, Ferrum acts as gold.'
- ইনফ্লুয়েজিনাম ৩০ বা ২০০ একমাত্রা সেবনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগ সেরে যায়। তবে এই ঔষধ এক মাত্রার বেশি প্রয়োগ নিষিদ্ধ। প্রথম অবস্থায় এটি ফলপ্রদ।
- গলায় শ্লেষ্মা ঘড়ঘড় করলে, অ্যান্টিম টার্ট উপকারী।
- শ্লেষ্মা ও বমি ভাব তার সঙ্গে থাকলে, ইপিকাক ৬ উপকারী।
- উত্তপ্ত জ্বালাকার শ্লেষ্মাভাব, দেহে জ্বালা প্রভৃতিতে আর্সেনিক, ৬ বা ৩০। আর্সেনিক ব্যর্থ হলে, আর্সেনিকের কুলক্ষণ সহ প্রবল বমি, বমিভাব ও অনান্য লক্ষণ থাকলে, সারকোল্যাকটিক এসিড, ৬ বা ৩০।
- প্রবল ব্যথা, হাড়ে ব্যথা, সন্ধিতে ব্যথা প্রভৃতিতে, ইউপেটোরিয়াম পার্ফ ৬x।
- প্রবল জ্বর, শীতবোধ, মাথাভার, তন্দ্রাভাব, ঝিমানো, অবসন্নতা, সর্বাঙ্গে ব্যথা ক্ষুধা তৃষ্ণার অভাব প্রভৃতিতে, জেলসিমিয়াম মাদার বা ৩০ উপকারী।
- মাথা, ব্যথা, চোখ লাল, আলো অসহ্য, প্রলাপ প্রভৃতিতে বেলেডোনা ৬।
- বর্ষাকালে কোমরে ব্যথাসহ, রাস্টক্স ৬ বা ৩০।
- বর্ষার ভিজে জ্বরে, ডাস্কামারা ৬ বা ৩০।
- অনিয়মিত পান, ভোজন, স্নান প্রভৃতির পর জ্বর এবং জরে তৃষ্ণাভাবে থাকে না, এই রকম লক্ষণে, পালসেটিলা ৬।
প্র্যাকটিস অব মেডিসিন By S N Pandey এর বই হতে হুবহু সংকলিত।